গাছের জীবন ধারণের জন্য কমপক্ষে ২০টি পুষ্টি উপাদান প্রয়োজন যার মধ্যে ১৭টি উপাদান গাছ মাটি থেকে গ্রহণ করে থাকে। পুষ্টি উপাদানগুলো সমপরিমাণে প্রয়োজন হয় না; কোনোটি বেশি আবার কোনোটির পরিমাণ কম প্রয়োজন হয়। তবে সবই জীবন ধারণের জন্য অত্যাবশ্যক। গাছ যে ১১টি পুষ্টি উপাদান কম পরিমাণে গ্রহণ করে থাকে তাদের অনুপুষ্টি বলে। বোরন একটি মাইকোনিউট্রিয়েন্ট বা অনুপুষ্টি। এটি মাটি ও উদ্ভিদ দেহে তেমন সচল নয়। মাটিতে এটা বোরেট এবং বোরেট সিলিকেট মিনারেল হিসেবে থাকে। ওপরের স্তরের মাটিতে মোট বোরনের গড় পরিমাণ সাধারণত ১০ পিপিএম হয় তবে প্রাপ্যনীয় (Available) বোরনের পরিমাণ ১ পিপিএমের অনেক কম। মাটিতে প্রাপ্যনীয় বোরনের সংকট মাত্রা ০.২০ পিপিএম এবং কোনো মাটিতে বোরনের উত্তম মাত্রা হলো ০.৪৫-০.৬০ পিপিএম। গাছের কোষ-কলায় বোরনের পরিমাণ সাধারণত ২০-১০০ পিপিএম এ পরিমাণ ১৫ পিপিএমের কম হলে ঘাটতি হয় আবার ১০০ পিপিএম বেশি হলে বিষাক্ততা (Toxicity) দেখা দিতে পারে।
বাংলাদেশের মাটিতে বোরন ঘাটতি
আমাদের দেশে নব্বইয়ের দশক থেকে বিভিন্ন মাটি ও ফসলে বোরনের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। অতি নিবিড় কৃষির কারণে মাটিতে বোরন গাছ কর্তৃক আহরিত হওয়া, মাটিতে জৈব পদার্থ কমে যাওয়া, অসুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ, এবং চুয়ানির ফলে মাটিস্থ বোরনের পরিমাণ কমে যাচ্ছে এবং ক্রমশ ঘাটতি লক্ষণ তীব্রতর হচ্ছে। মাটির বিক্রিয়া বেশি অম্লীয় হলে যেমন বোরন ঘাটতি হয় আবার বেশি ক্ষারীয় মৃত্তিকায়ও বোরনের ঘাটতি দেখা যায়। মাটির বিক্রিয়া বা পিএইচমান ৫.০-৭.০ এর মধ্যে থাকলে বোরনের প্রাপ্যনীয়তা উত্তম হয়।
বাংলাদেশের প্রায় ৪৭% জমিতে বোরনের ঘাটতি আছে। দেশের ৩০টি কৃষি পরিবেশ অঞ্চলের মধ্যে ১৯টি অঞ্চলে কম-বেশি বোরনের ঘাটতি আছে। বিশেষত দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, কুমিল্লা ও সিলেট জেলায় বোরনের ঘাটতি প্রকট। তাছাড়া, রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চল, গাজীপুর, টাঙ্গাইল ও ঢাকার কিয়দংশ, পাবর্ত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলার পাহাড়ি এলাকা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জ জেলার কিয়দংশ এলাকায় বোরন ঘাটতি দেখা যায়। রবি শস্যের মধ্যে গম, ভুট্টা, সরিষা, মুগডাল, ছোলা, সূর্যমুখী, ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, আলু, বোরন সংবেদনশীল। তাছাড়া পেঁপে, কাঁঠাল, পেয়ারা লেবু প্রভৃতি ফলজ বৃক্ষে বোরন ঘাটতি দেখা গেছে। বোরন সংবেদনশীলতা সাধারণত ফসলের শ্রেণী ও জাতের ওপর নির্ভরশীল। রবিশস্যে বোরন প্রয়োগ করলে পরবর্তী ধান ফসলে প্রয়োগ না করলেও চলে তবে বেলে প্রধান মাটিতে প্রতি ফসলেই বোরন প্রয়োগ প্রয়োজন। মাটি পরীক্ষার ভিত্তিতে বোরন সার প্রয়োগ বিধেয়।
বোরন উদ্ভিদের শর্করা বিপাকে সাহায্য করে ও আমিষ সংশ্লেষণে ভূমিকা পালন করে। উদ্ভিদের ভাজক কলা, বর্ধনশীল অংশ ও কোষ প্রাচীর গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ক্যালসিয়াম ও নাইট্রোজেন পরিশোষণে সহায়তা করে। তাছাড়া ফুলের ডিম্বানু নিষিক্ত করা, ফল ও বীজ ধারণে বোরন একান্ত আবশ্যক।
বৃক্ষের নাম | বয়স | মাত্রা (গ্রাম/গাছ/বছর) | |
বোরন | বোরিক এসিড | ||
আম, কাঁঠাল, নারিকেল, লিচু, লেবু, পেঁপে, ইত্যাদি | ১-৫ বছর | ৩-৫ গ্রাম | ১৮-৩০ গ্রাম |
৫-১০ বছর | ৫-৮ গ্রাম | ৩০-৩৫ গ্রাম | |
>১০ বছর | ৮-১০ গ্রাম | ৫০-৬০ গ্রাম |
বোরনের ঘাটতি লক্ষণ
বোরন অচলমান (Immobile) হওয়ায় এর ঘাটতি লক্ষণ সাধারণত কচি পাতায় দেখা যায়। বিভিন্ন শস্য ও ফলে বোরনের ঘাটতি বিভিন্ন ধরনের হয়। তবে ঘাটতি লক্ষণগুলো হলো-
০১. গাছের কাণ্ডের শীর্ষ ভাগ শুকিয়ে যায় বা মরে যায়;
০২. পাতা ঈষৎ হলুদাভ হয় এবং কখনও কখনও পাতা মোড়ানো আকার ধারণ করে এবং ভঙ্গুরতা প্রদশর্ন করে;
০৩. গাছে পর্যাপ্ত পানি সেচ দেয়ার পরও কচিপাতা নেতিয়ে পড়া অবস্থায় থাকে;
০৪. বোরনের ঘাটতি তীব্র হলে গমের শীষ, ভুট্টার মোচায় দানা তৈরি হয় না এবং ফুলে পরাগায়ন প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় বন্ধাত্ব দেখা দেয়;
০৫. ডাল জাতীয় ফসলে দানা সংখ্যা কম হয় এবং দানা অপুষ্ট হয়। গাছ খর্বাকৃতি ও হলুদ হয়ে যেতে পারে; অভাব তীব্র হলে পচনজনিত ক্ষত সৃষ্টি হতে পারে;
০৬. তৈল জাতীয় ফসলের পডে (শিম) বীজের সংখ্যা কমে যায়;
০৭. আখের পাতা শীর্ষ ভাগে ও কোনায় পুড়ে যাওয়ার লক্ষণ দেখা দেয়।
০৮. পেঁপে, কাঁঠাল, পেয়ারা ফলের আকার বিকৃতি হয়;
০৯. ফুলকপি ও বাঁধাকপির পাতা সজীবতা হারায় এবং পাতায় হাত দিলে খসখসে অনুভূত হয়। ফুলকপির কাডবিবর্ণ হয়ে নষ্ট হয়;
১০. অভাব তীব্র হলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে গাছের শিকড়ের বৃদ্ধি মন্থর হয়ে যায় এবং ফুল ধারণ কমে যায়।
সার সুপারিশ
রবিশস্য জাতীয় ফসলের জন্য বোরন হেক্টরপ্রতি ১-২ কেজি এবং বোরিক এসিড ৬-১২ কেজি।
ফলজ বৃক্ষের জন্য
প্রয়োগ বিধি
রবিশস্য জাতীয় ফসলের জন্য- জমি তৈরির শেষ চাষের সময় একটি পাত্রে পরিমাণমতো ঝুরঝুরে মাটির সাথে বোরিক এসিড ভালোভাবে মিশিয়ে জমিতে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।
ফলজ বৃক্ষের ক্ষেত্রে- বাড়ন্ত ফলজ বৃক্ষের জন্য বোরন সার বছরে দুইবার প্রয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনীয় মাত্রার অর্ধেক বর্ষাকালের আগে এপ্রিল-মে মাসে এবং ২য় কিস্তি বৃষ্টির পরে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে প্রয়োগ করতে হবে। গাছের গোড়া থেকে ০.৫ মিটার-১.৫ মিটার দূরে চার দিকে রিং পদ্ধতিতে প্রয়োগ করে হালকা সেচ দিতে হবে।
পাতায় সিঞ্চন পদ্ধতিতে প্রয়োগ
প্রতি লিটার পানিতে ২-৪ গ্রাম বোরন মিশিয়ে স্প্রে মেশিন দিয়ে সমভাবে পাতায় স্প্রে করতে হবে। ফসলভেদে হেক্টরপ্রতি ৬০-১২০ লিটার স্প্রে দ্রবণ প্রয়োজন হতে পারে। ফলজ গাছে বোরন ঘাটতি দেখা দিলে সঠিক মাত্রায় বোরন দ্রবণ স্প্রে করে গাছের পাতা ভিজিয়ে দিতে হবে।
সাবধানতা
০১. বোরন সার প্রয়োগ করার আগে মাটি পরীক্ষা করে মাটিতে বোরনের ঘাটতির পরিমাণ জেনে নেয়া উত্তম;
০২. পাতায় স্প্রে করার ক্ষেত্রে সূর্যাস্তের আগে দিনের যে কোনো উপযুক্ত সময়ে (মেঘলা দিন হলে ভালো হয়) স্প্রে মেশিন দ্বারা স্প্রে করতে হবে;
০৩. সুপারিশকৃত মাত্রার অতিরিক্ত বোরন প্রয়োগ করা যাবে না। বেশি প্রয়োগ করলে বিষাক্ততা দেখা দিতে পারে।
বাংলাদেশের মাটি ও ফসলে বোরনের ঘাটতি ক্রমান্বয়ে ব্যাপক হচ্ছে। ফলে বিভিন্ন ফসলের ফলন ও গুণগতমান কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। খাদ্য উৎপাদনের ক্রমবর্ধমান লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য ও মৃত্তিকার স্বাস্থ্য বজায় রাখার স্বার্থে অন্যান্য সারের সাথে সমন্বিতভাবে বোরন সার প্রয়োগ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। সুপারিশকৃত মাত্রা ও বিধি মোতাবেক বোরন সার প্রয়োগ কৃষি উৎপাদন টেকসইকরণের জন্য তাই একান্ত জরুরি।
ড. নির্মল চন্দ্রশীল* ড. রওশন আরা বেগম**
*প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, **মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ, বিএআরআই, জয়দেবপুর, গাজীপু
0 Comments